‘লাক্বাদ জা আকুম রাসুলুম মিন আনফুসিকুম আজিজুন আলাইহি…। তোমাদের মাঝে এসেছেন এক প্রেমময় নবী, যিনি সবার জন্য নেগাহবান।
আসুন দেখি তিনি শৈশবে কৈশোরে যৌবনে প্রৌঢ়ে কেমন ছিলেন। আমুল ফিল বা হস্তী বাহিনী অবরোধের বছর ১২ রবিউল আউয়ালে দুনিয়ার বুকে মা আমিনার কোলজুড়ে নেমে এলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন নবীয়ে দুজাহা রাসূলে আকরাম সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুন্নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লামাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আমদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল নবীজি সাল্লাল্লাহুর আগমন স্মরণ করে গেয়ে উঠেছেন ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে’। কিংবা ‘ত্রিভুবনে প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়… আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়…’
জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দাস মুক্তি
আবু লাহাব বনু হাশিমের গদীনশীন হিসেবে খানায়ে কাবার অন্যতম খাদেম। সম্পর্কে নবীজি সাল্লামাহুর সাক্ষাৎ চাচা। তিনি তার দাসী সুয়াইবিয়াকে মা আমিনার ঘরে পাঠান প্রবসকালীন সেবা শুশ্রূষার জন্য।
প্রায় বিনা কষ্টে মা আমিনার কোলজুড়ে নেমে এলো পূর্ণিমার চাঁদ ইবনে আবদুল্লাহ আমিনা দুলাল নবী মুহাম্মদ সাল্লামাহু। আরবরা সুন্দর চেহারার মানুষকে চন্দ্র-সূর্যের সঙ্গে তুলনা করতেন, যেমন হিজরতের সময় মদিনার আবালবৃদ্ধবনিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গেয়ে উঠেছিল ‘ত্বালাআল বাদরু আলাইনা….
মা আয়েশা নবীজি সাল্লামাহুর শানে আবৃত্তি করতেন ‘শামসুদ্দুনিয়া তাত্বলাঊ বা’দাল ফাজরি/ ওয়াশ শামসি তাত্বলাঊ বা’দাল ইশায়ি (দুনিয়ার সূর্য উঠে ফজর শেষে।
আমার সূর্য উদিত হয় এশার পরে আমার পাশে) তো সুয়াইবিয়া এমন আলোকিত মুখ দেখে আবু লাহাবের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলেন ‘আপনার ভাইয়ের সদ্য বিধবা স্ত্রী আমেনার কোলে ভূমিষ্ঠ হয়েছে নজরকাড়া এক পুত্রসন্তান।
কথাটি শুনে আবু লাহাব আবদুর রহমান বিন আবদুল মোত্তালিব এত আনন্দিত হন যে তার গলায় পরা মুক্তার মালা উপহার দিয়ে সুয়াইবাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন।
দুধ মা হালিমার কোলে
ইনসাফের দৃষ্টান্ত
মক্কার অভিজাত পরিবারে প্রথা ছিল নবজাত সন্তানদের শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোনো স্বাস্থ্যকর এলাকায় দাইমা কর্তৃক লালনপালন। সে হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ ছিল তায়েফ। তায়েফবাসীরা দলে দলে শহরে আসত কোনো ধনীর নবজাতককে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে হিসেবে হালিমাতুস সাদিয়া আসে তার স্বামীকে নিয়ে।
কিন্তু মক্কার লোকেরা তাদের পোশাক আশাক সাওয়ারি দেখে পছন্দ না হওয়ায় কেউ তাদের সন্তান দিচ্ছিল না। ওদিকে এতিম মুহাম্মদকে কেউ নিচ্ছিল না যথাযথ পরিতোষক পাবে না বলে। হালিমাতুস সাদিয়ার মন খারাপ। কাফেলার সবাই কোলে নবজাতক পেয়েছে পালক সন্তান হিসেবে, সে এখনও কাউকে পায়নি।
আবার মক্কার অলিগলি ঘুরছে, গাজ্জা মহল্লায় খোঁজ পায় এতিম মোহাম্মদের। তাকেই কোলে তুলে নেয় সোহাগভরে। স্বামী বলে এতিম শিশু নিয়ে লাভ কী? হালিমা বলেন খালি হাতে যাওয়ার চেয়ে একে নিয়েই যাই এতিমের সেবায় আল্লাহ আমাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবেন।
ইতোমধ্যে তাদের সাথীরা তায়েফের পথ ধরেছে। হালিমার পরিবার পিছে পড়ে গেছে কিন্তু শিশু নবীকে সাওয়ারিতে উঠানোর পর উটের চলার গতি বেড়ে যায়। তারা নাগাল পেয়ে যায় সাথীদের। হালিমার কোলে আগে থেকেই ছিল তার গর্ভজাত সন্তান।
এখন কোরাইশি সন্তান মোহাম্মদকে নিয়ে তার দুগ্ধপোষ্য দুই সন্তান। হালিমা লক্ষ করে মোহাম্মদ তার বুকের ডান দিকের দুধ ছাড়া বাঁ দিকের দুধে মুখ দেয় না, এমনকি সেখানে তার মুখ লাগিয়ে দিলেও তা মুখে নেয় না। হালিমা বুঝতে পারে এ কোনো সাধারণ সন্তান নয়।
সে আসার পর তার পালের বকরিগুলো মোটাতাজা হয়ে গেছে সাধারণ পরিমাণের চেয়ে বেশি দুধ দিচ্ছে।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবী সাল্লামাহু
হুব্বিবা ইলাইয়্যা মিন দুনিয়া সালাস। নবীজি সাল্লামাহু ফরমান হুব্বিবা ইলায়্যা মিন দুনইয়া সালাসুন। দুনিয়ার তিনটি বস্তু আমার কাছে মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রেমময় করা হয়েছে। আততীব ওয়াননিসা ওয়া ক্বুররাতু আঈনি ফিসসালাত। ১. খুশবু বা সৌরভ, ২.বিদূষী নারী, আর ৩. নামাজ তো আমার চোখের শীতলতা আনয়নকারী। সুগন্ধ, নারী এবং নামাজ এ তিন বস্তু নবীজি সাল্লামাহুর প্রিয়।
সুগন্ধ এবং নামাজের বিষয়ে কেউ প্রশ্ন না তুললেও নারীর বিষয় কেউ কেউ প্রশ্ন ওঠাতে পারে। নবীজি সাল্লামাহু নারীকে প্রিয় বলার কারণ কি। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের পরে যিনি খুশিতে আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি ছিলেন আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবিয়া। আরবের প্রথানুযায়ী গ্রামীণ এক গরিব মহিলা তাকে দুধ পান করানোর জন্য কোলে তুলে নিয়েছিলেন হালিমাতুস সাদিয়া।
নবুয়তপ্রাপ্তির পর এমনকি তার আগেও যিনি তাকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত নারী বিবি খাদিজা (রা.)।
কোরআনে পাকে নারী বা নিসা নামে স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে। এ নিসা শব্দটি কোরআনে ২৬ বার এসেছে। আর ইমরাআতুন বা মহিলা শব্দটি এসেছে ৫৭ বার।
এ ছাড়া কোরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
ইসলাম নারীকে দিয়েছে ন্যায্য অধিকার সম্মান জানমালের নিরাপত্তা। যা নবীজি সাল্লামাহু বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন। বর্তমানে মানুষ একজন বিবির মন রক্ষায় যেখানে কুণ্ঠিত সেখানে নবীজি একাধিক বিবি নিয়ে সুখের সংসার করেছেন।
রাসূল (সা.)-এর জন্মই ছিল নারীকে দাসত্ব থেকে মুক্তি করার বৈপ্লবিক ঘোষণা। আবু লাহাব ছিলেন কাবা শরিফের অন্যতম খাদেম। সম্পর্কে নবীজির আপন চাচা। তিনি দাসী সুয়াইবিয়াকে মা আমেনার ঘরে পাঠান প্রসবকালীন সেবার জন্য। সুয়াইবিয়া শিশু মুহাম্মদের জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আবু লাহাবের কাছে দৌড়ে এলেন।
বললেন, আপনার ভাইয়ের সদ্য বিধবা স্ত্রী আমেনার কোলে ভূমিষ্ঠ হয়েছে নজরকাড়া এক পুত্রসন্তন। কথাটি শুনে আবু লাহাব এতই আনন্দিত হন, তার গলায় পরা মুক্তার মালা উপহার দিয়ে সুয়াইবাকে আজাদ বা দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন।
রাসূল (সা.) বলেন, দুনিয়ার তিনটি জিনিস আমার কাছে মর্যাদা সম্পন। ১. খুশবু বা সুগন্ধি, ২. বিদূষী নারী, আর ৩. নামাজ কোরআনে নারী বা নিসা নামে স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে। এ নিসা শব্দটি কোরআনে ২৬ বার। আরইমরাআতুন বা মহিলা শব্দটি এসেছে ৫৭ বার।
এ ছাড়া কোরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ইসলাম নারীকে দিয়েছে ন্যায্য অধিকার, সম্মান, জানমালের নিরাপত্তা। যা নবীজি তার জীবনে বাস্তবায়ন করে পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়ে গেছেন।
ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, আল জান্নাতু তাহতা আকদামিল উম্মুহাত। অর্থ, তোমাদের মায়েদের পায়ের নিচে রয়েছে জান্নাত। অর্থাৎ মা সম্পর্কীয় যারা আছেন তাদের সেবা করলে, খোঁজখবর রাখলে জান্নাতের পথ সহজ হবে।
আবু হুরায়রার (রা.) বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি নবীজির কাছে জানতে চাইলেন, আমার ভালো আচরণ পাওয়ার বেশি অধিকার কার?
নবীজি বললেন, তোমার ‘মা’য়ের। ওই লোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কার? নবীজি বললেন, তোমার ‘মা’য়ের। সে ব্যক্তি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, সুম্মা মান, তারপর কার? এবারও নবীজি উত্তর দিলেন, উম্মুকা তোমার ‘মা’য়ের। সুম্মা আবুকা এরপর তোমার জন্মদাতা পিতার।
কন্যা ও বোন হিসেবে নারীর সম্মান। খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা দরবারে রিসালাতে এলে নবীজি দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে নিজের চাদর বিছিয়ে দিতেন বসার জন্য।
কন্যাসন্তানকে তিনি খায়ের বারাকাত বা কল্যাণ ও প্রাচুর্যের প্রতীক মনে করতেন। কন্যাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সৎ পাত্রস্থ করলে জান্নাত সুনিশ্চিত বলে নবীজি বলেছেন।
নবীজি বলেন, ‘কারও যদি কন্যা ও পুত্রসন্তান থাকে আর সে যদি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু নিয়ে আসে, তাহলে প্রথমে যেন সে মেয়ের হাতে কিছু দেয়। হাদিস শরিফে আছে, বোনের সেবাযত্ন লালনপালন করলে আল্লাহ প্রাচুর্য দান করেন।
স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মান। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। কোরআনে আছে, হুন্না লিবাছুল্লাকুম তারা তোমাদের পোশাক, ওয়া আনতুম লিবাছুল্লাহুন্না আর তোমরা তাদের পোশাক। পোশাক যেমন সর্দি-গর্মি থেকে রক্ষা করে এবং তোমাদের লজ্জা নিবারণ করে স্ত্রীরাও তেমনি। রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে সে উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।
বিধবার অধিকার ও সম্মান। নবীজির একাধিক বিয়ের অন্যতম কারণ ছিল বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্তদের মর্যাদার জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বিধবাদের অধিকার সম্পর্কে নবীজি বলেছেন, যারা বিধবা নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, তারা আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজি ও সদা রোজা পালনকারীর সমতুল্য।
নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন এবং রাখবেন নারী ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আসুন ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে নারীদের মর্যাদা রক্ষার শপথ নেই। একটি বিখ্যাত হিন্দি প্রবাদ আছে ‘বাপ কী জাগ্গা মা হু ভি সাক্তা হায় মা কী জাগ্গা বাপ হুনেহি সাক্তা’। বাবার জায়গায় মা হতে পারেন, কিন্তু মায়ের জায়গায় বাবা হতে পারেন না।
লেখক : প্রাবন্ধিক
Email : mueenchishty@gmail.com
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-